মঙ্গলবারের বিকেলটা একটু অন্যরকম ছিল। আকাশে লালচে আভা, হালকা বাতাস আর গোধূলির নিস্তব্ধতা যেন এক অনির্বচনীয় আবেশ ছড়িয়ে দিচ্ছিল। কলেজের ক্লাস শেষ হওয়ার পর আসিফা বলল, "আজ একটু বেরোবে আমার সঙ্গে?" আমি চমকে উঠলাম। সাধারণত ও-ই ডাক দেয় না, তবে আজ যেন কিছু বলতে চাচ্ছিল যা ভাষার বাঁধনে ধরা দিচ্ছিল না। আমি এক মুহূর্ত ভাবলাম, তারপর মাথা নাড়লাম, "চল, পার্কে যাই।"

পার্কে পৌঁছানোর পর চারপাশের পরিবেশটা আরও সুন্দর মনে হচ্ছিল। গাছের পাতা গুঞ্জন তুলছিল বাতাসে, আর পাখিরা যেন আমাদের নিঃশব্দ কথোপকথনের সাক্ষী হয়ে বসে ছিল। আসিফা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল, বেঞ্চের এক পাশে বসে পড়ল। তার পরনে ছিল লম্বা স্কার্ট, হাতা অবধি ঢাকা জামা, আর পায়ে ছিল কালো বুট। সে পা দুটো সামনে বাড়িয়ে দিল, যেন ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে চায়। আমি পাশে গিয়ে বসতেই সে এক গভীর দৃষ্টিতে তাকাল, চোখে এক অজানা ভাষা।

সন্ধ্যার আলো আরও গাঢ় হচ্ছিল। পার্কে মানুষ কমতে শুরু করেছে। বাতাস একটু শীতল হয়ে উঠেছে। আসিফা ধীরে ধীরে হাত রাখল বেঞ্চের ওপর, আঙুলগুলো শিথিল, কিন্তু কোথাও যেন অদৃশ্য এক আকর্ষণ। আমি তার দিকে তাকালাম, মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি। হয়তো এটাই আমাদের সম্পর্কের এক নতুন মোড়, যেখানে শব্দের প্রয়োজন নেই, অনুভূতিই যথেষ্ট।

"তুই জানিস, মাঝে মাঝে মনে হয় আমি তোকে অনেক কিছু বলতে চাই, কিন্তু ভাষা খুঁজে পাই না," আসিফা হেসে বলল।

আমি মৃদু হাসলাম, "সব অনুভূতির জন্য শব্দ দরকার হয় না।"

আসিফা কিছু বলল না। শুধু পায়ের কালো বুটের ফিতে খুলতে লাগল, যেন একটা শিথিলতার দরকার ছিল ওর। আমি জানতাম, আজকের সন্ধ্যাটা অন্যরকম হবে, এক অনুচ্চারিত সত্যের সন্ধ্যা। আমাদের সম্পর্কের পরতে পরতে যে আকর্ষণ আর চাওয়া লুকিয়ে ছিল, তা আজ প্রকাশের অপেক্ষায়।

আমি তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, হালকা বাতাসে তার চুল উড়ছে। চোখে এক অদ্ভুত আলো, যেন কিছু বলবে, কিন্তু থেমে যাচ্ছে। আমি আস্তে করে বললাম, "কী ভাবছো?"

সে একটু চুপ করে থেকে বলল, "জানি না, আজকে তোকে খুব কাছের মনে হচ্ছে। তোর সঙ্গে এত বছর ধরে আছি, কিন্তু আজ যেন নতুন করে সবকিছু অনুভব করছি।"

আমি কিছু বললাম না। শুধু তার হাতটা আমার হাতে নিয়ে বললাম, "আমি তো সবসময় তোর কাছেই আছি।"

আসিফা ধীরে ধীরে মাথা নিচু করল। চুপচাপ বসে রইলাম আমরা। পার্কের বাতাস গাঢ় হয়ে উঠল, যেন আমাদের অনুভূতির সাক্ষী হয়ে রইল। সময় থমকে গেল, আমাদের মনে সেই সন্ধ্যার আলো দীর্ঘস্থায়ী হয়ে রইল।

অন্ধকার একটু গাঢ় হতে না হতেই হঠাৎই সে আমার দিকে তাকিয়ে একরকম কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, "তোর কি কখনও মনে হয়, আমাদের মধ্যে কিছু... আরও গভীর কিছু হতে পারত?"

আমার বুকের মাঝে যেন ঢেউ উঠল, কিন্তু বাইরে তা বুঝতে দিলাম না। আমি মৃদু হাসলাম, "তুই কী বলতে চাস?"

সে মুখ নিচু করল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, "আমার মনে হয়, তুই বোঝছিস। আমাদের সম্পর্ক এতদিন ধরে একই জায়গায় আটকে আছে। কিন্তু..."

আমি তার চোখের দিকে তাকালাম। তার ভেতর যেন এক ধরনের না বলা আকাঙ্ক্ষা খেলা করছিল। আমি আস্তে করে তার হাতটা শক্ত করে ধরলাম। চারপাশ নিঃশব্দ, শুধু দুজনের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দই কানে আসছিল।

আসিফা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর ধীরে ধীরে আমার কাঁধে মাথা রাখল। ঠান্ডা বাতাস তার শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছিল, আর আমি অনুভব করছিলাম তার হৃদস্পন্দন।

সে একটু নড়েচড়ে আমার আরো কাছ ঘেঁষে এল। আমি অনুভব করলাম তার শ্বাস আমার গালের কাছে এসে পড়ছে। সময় থমকে গেল, বাতাসও যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। আমরা দুজনই বুঝতে পারছিলাম, কিছু একটা বদলে যাচ্ছে আমাদের মধ্যে। আমাদের নিঃশব্দ কথোপকথনেই উত্তেজনার এক অদৃশ্য ঢেউ বয়ে চলল।

আমি ধীরে ধীরে তার চুলে হাত রাখলাম, আলতো করে আঙুল বুলিয়ে দিলাম। আসিফা চোখ বন্ধ করল, এক গভীর শ্বাস নিল, যেন মুহূর্তটাকে সংরক্ষণ করতে চাইছে।

চারপাশে নীরবতা, শুধু হৃদস্পন্দনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমাদের সম্পর্কের সীমারেখা আজ অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, অনুভূতির তীব্রতায় আমরা একে অপরের দিকে আরও এগিয়ে যাচ্ছি।

আসিফার হাত ধীরে ধীরে তার স্কার্টের প্রান্ত ছুঁলো, হালকা বাতাসে কাপড়ের নরম ভাঁজ দুলে উঠল। গোধূলির আলোয় তার শরীরের অবয়ব আরও রহস্যময় হয়ে উঠল। তার চোখে এক গভীর আবেগ খেলা করছিল, আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম।

সেই রাত, সেই অনুভূতি, সেই স্পর্শ—সবকিছুই আমাদের ভেতরের লুকিয়ে থাকা আবেগের দরজা খুলে দিল। আমাদের সম্পর্ক সেই রাতে নতুন রূপ নিল, যেখানে শারীরিক স্পর্শ নয়, বরং এক গভীর আকর্ষণের অদৃশ্য সেতু আমাদের বাঁধল নতুন করে।